টানা চারবারের ভূমিকম্পের ঘটনায় এবং যেকোন সময় আবারও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কায় অনেক বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে নগরবাসী। কারণ, ঘনবসতি ও অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবণের কারণেই নগরবাসী এ আতঙ্কে ভুগছেন বলে জানাগেছে।
নগরবাসী বলছেন, রাজধানী ঢাকার মতও নারায়ণগঞ্জ অত্যান্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। শিল্পনগরী হওয়ায় এখানে বিভিন্ন জেলার মানুষ বাস করে। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনবসতি এবং বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে শক্তিশালী কিংবা মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হলেও হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হবে।
জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডে অবস্থিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে প্রায় ৪১টি। ২০১৮ সালের নাসিকের স্থাপত্য বিভাগের সার্ভে ওই ৪১ টি ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সেই তালিকা থেকে কমেছে মাত্র চারটি ভবন। অর্থ্যাৎ এখনও ৩৭ টি ভবন ঝুঁকির মধ্যেই থেকে গেছে। বাড়িওয়ালাদের গাফলতি, মামলা জনিত সমস্যা এবং আইনি জটিলতার কারনে ঝুঁকিতেই থেকে গেছে ভবনগুলো।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার বিপুলসংখ্যক ভবন বহু বছর ধরে কাঠামোগত মূল্যায়ন ছাড়াই ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ভবন অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত নয়, আবার অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদনবিহীন তলা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে মাঝারি মাত্রার কম্পনেও এসব ভবনে বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এদিকে শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফাটল দেখা দিয়েছে। শনিবার সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক এসব স্থানে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেই সাথে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করছে। গ্যাস লাইন লিকেজ, বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়া এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে প্রবেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
এরপর শনিবার আরও তিনটি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো নরসিংদী ও ঢাকায়। বড় ভূমিকম্পের ঘাঁ শুকাতে না শুকাতেই আরও তিনটি ভূমিকম্পনের ঘটনায় খুব বেশি আতঙ্ক করে তোলে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীসহ গোটা দেশবাসীকে।
এদিকে অল্প সময়ে বারবার এ ভূমিকম্পন হওয়াকে বড় বিপর্যয়ের আভাস দিয়েছে বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চারটি ভূমিকম্পই ‘ফোরশক’। বড় কম্পনের আগে প্লেটের ওপর চাপ বাড়তে থাকে, ছোট ছোট কম্পন সেই চাপের ইঙ্গিত। ভূঅভ্যন্তরে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। সামনে আরও কয়েক দিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এ কারণে অবিলম্বে প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
এদিকে ফের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় নরসিংদীর হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ভূমিকম্প থেকে বাঁচাতে গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় অবস্থান করেন। এদিকে নরসিংদীর মত নারায়ণগঞ্জেও বহু মানুষকে আতঙ্ক হয়ে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে।
নগরবাসী আরও বলছেন, নারায়ণগঞ্জ ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল নরসিংদীর খুব কাছেই অবস্থিত। এছাড়া এ অঞ্চল অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অলরেডি চারবার ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনে ভয়াবহ ভূমিকম্প হতে পারে। ফলে সেখানে ফের শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে নারায়ণগঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এমনও হতে পারে ভূমিকম্পের ফলে গোটা নারায়ণগঞ্জই ম্যাসাকারে পরিনত হবে। তাই এখন থেকেই সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়তো, এ ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবে না বলেও দাবি করেন নগরবাসী।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝারি ঝুঁকিতে থাকা নারায়ণগঞ্জে তাতক্ষণিকভাবে ভবনের কাঠামোগত মূল্যায়ন, প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন, জরুরি বহির্গমন পথ নিশ্চিতকরণ এবং নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া আয়োজন করা প্রয়োজন। তাদের মতে, ভূমিকম্পের মাত্রা ছোট হলেও সতর্ক না থাকলে ক্ষয়ক্ষতি বড় হতে পারে।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে মাধবদীতে, কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। স্থায়িত্ব ছিল ২৬ সেকেন্ড। মূল কম্পনের তীব্রতায় নরসিংদী, গাজীপুর ও ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জেও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জসহ তিন জেলায় প্রাণ হারান অন্তত ১০ জন, আহত ছয় শতাধিক। ঢাকার বহু ভবনে ফাটল, কোথাও কোথাও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএসের মতে, শুক্রবার বাংলাদেশের সাত কোটির মতো মানুষ মৃদু বা হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
এরপর গতকাল শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে আরও একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। এটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর পলাশ। রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩। একই দিন শনিবার সন্ধ্যায় পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়।
এটির উৎপত্তিস্থল ছিল রাজধানীর বাড্ডায়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩, উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে।