বুলেটের মুখে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম। কখনও প্রাণের মায়া করেনি। বার বার মনে হচ্ছিলো দেশে একটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। আমার জীবনের চাইতেও হয়তো এ পরিবর্তনটা জরুরী ছিলো। তাই চলে গিয়েছিলাম রাজপথে। কিন্তু ওই ফ্যাসিস্টদের পুলিশবাহিনী সেদিন নির্বিচারে গুলি করেছিলো। হয়তো একটা গুলি আমার শরীরেও লাগতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ্’র হুকুমে সেদিন আমি বেঁচে যাই। কথাগুলো বলছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ ৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মহানগর ছাত্রদলের সাবেক স্কুল বিষয়ক সম্পাদক ইরফান ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, সেদিনের কথাগুলো মনে হলে আজও আত্কে উঠি। কি ভয়ংকর ছিলো সেদিনের দিনগুলি। তার বিবরণ হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু সেদিন ছাত্র-জনতা নিজেদের প্রাণের মায়া ছেড়েদিয়েছিলো বলেই আজ ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
জুলাই স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সাহসী ছাত্রনেতা ইরফান ভূঁইয়া আরও বলেন, আসলে আমাদের আন্দোলনটা মূলত শুরু হয় ১৭ জুলাই থেকে। এদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতার সাথে আমরাও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নেই। অনেকটা শান্ত নদীর মতই আমাদের এ আন্দোলনটা চলতে থাকে। কিন্তু ১৮ ও ১৯ জুলাই ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও তৎতকালিন ক্ষমতাসীন বাহিনীর হামলার কারণে তা অনেকটা ভয়ংকর হয়ে উঠে। তারা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে ছাত্রদের দিকে। তাদের হামলায় শতাধীক ছাত্র জনতা সেদিন আহত হয়। এরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা।
তিনি বলেন, ১৯ জুলাই শুক্রবার সকাল থেকেই আমরা মহাসড়ক ও এর আশে পাশের সড়কগুলোতে অবস্থান করি। এদিন পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সাথে আমাদের তুমুল সংঘর্ষ হয়। গডফাদার শামীম ওসমানরা গাড়িবহন নিয়ে মহড়া দেন আর তার অনুসারীরা অস্ত্র হাতে নেমে আসে রাজপথে। এছাড়া হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি, সাইন্ড গ্রেনেড আর কাঁদানে গ্যাস অলি গলিতে ছড়িয়ে পরে। তখন আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, হাত-মুখ জ¦লে যাচ্ছিলো। সহযোদ্ধারা কোথা থেকে যেন টিসু ভিজিয়ে এনে আমাকে দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে নাকে মুখে লাগাতেই কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই। এরপর আবার উঠে দাঁড়াই। পুলিশের হামলার জবাব দেয়ার চেষ্টা করি। বিকেলের দিকে শিমরাইলের পুলিশ ক্যাম্প থেকে আমাদের ওপর ছোড়া হয় গুলি। এসময় বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমরা রাজপথ থেকে সরে যাইনি। চলতে থাকে আমাদের আন্দোলন।
তিনি বলেন, পরবর্তিতে আমার বিরুদ্ধে ৪টি মামলা দেয়া হয়। মামলার বোঝা কাঁধে নিয়েও আমি রাজপথে অবস্থান করি। ২৮ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জের বার্মাস্ট্যান্ড এলাকা থেকে সহযোদ্ধা মো: গণি মিয়া ও শাকিলসহ আমাদের গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ভেবেছিলাম আমাদের হয়তো হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলবে পুলিশ। কিন্তু না। তারা আমাদের কোর্টে চালান করে দেয়। এরপরের ঠিকানা হয় জেলখানা। এরপর জেলখানায় বসেও আরও ৩ মামলার আসামী হই আমি। অবশেষে কারাযাপনের প্রায় ৮দিনের মাথায় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মূলত ৫ আগস্টে আমাদের বিজয়ের খবরটা আমি কারাগারে বসেই পাই। খবরটা শোনার সাথে সাথে যেন আমার মনের সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। আর এক মহুর্তও জেলখানায় ভালো লাগছিলো না। বার বার মনটা অস্থির হয়ে উঠছিলো কখন কারামুক্তি পাবো। অবশেষে ৬ আগস্ট জামিন পেয়ে মুক্তিলাভ করি আমরা।
ছাত্রদল নেতা ইরফান বলেন, যদি ৫ আগস্ট দেশের পট পরিবর্তন না হতো তাহলে আমাদের যে কি হতো তা ভাবলেই শরীর শিউরে উঠে। কারণ, কোন অবস্থাতেই আমার আর জামিন মিলতো না। বরং কারাগারে থেকেই আরও মামলার আসামী হতে হতো। ফলে বছরের পর বছর আমাদের কারাগারেই থাকতে হতো। এ জন্য আমি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।